রাখাইন পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল হয়ে উঠছে। মিয়ানমারের সরকারি বাহিনী ও আরাকান আর্মির মধ্যে যুদ্ধ, রোহিঙ্গাদের মানবঢাল হিসেবে উভয়পক্ষের ব্যবহার এবং খাদ্য সংকটের কারণে পরিস্থিতি দিন দিন আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে। গোটা পরিস্থিতির দিকে নজর রাখছে বাংলাদেশ। খাদ্যের অভাবে সৃষ্ট মানবিক সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ এবং রোহিঙ্গাদের মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার না করার জন্য এরইমধ্যে মিয়ানমারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে বাংলাদেশ বলে জানিয়েছে একাধিক সূত্র।
এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, খাদ্য সংকট এবং যুদ্ধের কারণে রাখাইনের মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে। এদের বেশিরভাগই হচ্ছে রোহিঙ্গা। কারণ তারাই ওই অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে মিয়ানমার সরকারকে জানানো হয়েছে যে খাদ্য পরিস্থিতির উন্নতি না হলে সেখানকার রোহিঙ্গাদের সীমান্ত অতিক্রম করার পরিস্থিতি হতে পারে, জানান এই কর্মকর্তা।
রাখাইনে বর্তমানে রোহিঙ্গা রয়েছে ৬ লাখ ৩০ হাজারের মতো। এর মধ্যে বড় অংশটি থাকে বুথিডং অঞ্চলে এবং সেই এলাকা বর্তমানে আরাকান আর্মির দখলে। এরপর বেশি সংখ্যায় রোহিঙ্গা আছে সিতওয়ে অঞ্চলে।
এ বিষয়ে পররাষ্ট্র দফতরের আরেকজন কর্মকর্তা বলেন, মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও আরাকান আর্মি উভয়ই রোহিঙ্গাদের মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে মিয়ানমার সেনাবাহিনীতে রোহিঙ্গাদেরও কন্সক্রিপ্ট সৈন্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার ঘোষণা দেয়া হয়। গত এপ্রিল থেকে এটি কার্যকর শুরু হয়েছে। প্রথম ধাপের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত রোহিঙ্গাদের মংডুতে সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে পাঠানোর কথা, বিভিন্ন সূত্রে এ তথ্য শোনা যাচ্ছে বলে জানান ওই কর্মকর্তা। আরেক কর্মকর্তা বলেন, আরাকান আর্মিও রোহিঙ্গাদের দলে অন্তর্ভুক্ত করছে এবং তাদের সম্মুখভাগে রাখছে। ফলে প্রথম হতাহতের শিকার হন রোহিঙ্গারা। গত নভেম্বরে আরাকান আর্মি তাদের হামলার পরিমাণ বাড়িয়ে দেয় এবং এর প্রভাব পড়ে বাংলাদেশে। গত জানুয়ারি মাসে সীমান্ত এলাকায় মিয়ানমার বাহিনীর সঙ্গে আরাকান আর্মির একাধিক সংঘর্ষ হয়। এর সরাসরি প্রভাবে বাংলাদেশ অংশের সীমান্ত অশান্ত হয়ে ওঠে।
এ বিষয়ে আরেকজন কর্মকর্তা বলেন, আমরা গত নভেম্বর থেকে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষকে মানবিক সংকট নিরসনে ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে আসছি। গত বছর রাখাইনে ফসল ভালো না হওয়ায় সেখানে খাদ্য সংকট তৈরি হয়েছে। এই সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় সরকার সঠিক কোনও পদক্ষেপ নেয়নি। রাখাইনের যেসব জায়গা মিয়ানমার বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, সেখানে নিয়ন্ত্রিতভাবে কিছু খাদ্য সরবরাহ করছে দেশটির সরকার। এর অন্যতম কারণ হলো নিয়ন্ত্রণহীন এলাকায় খাদ্য পাঠালে সেটি আরাকান আর্মি তাদের দখলে নিয়ে নিচ্ছে বলে তিনি জানান। এই কর্মকর্তা বলেন, ফেব্রুয়ারি মাসে রোহিঙ্গাদের কন্সক্রিপ্ট হিসেবে ব্যবহারের খবর পাওয়ার পর আমরা তাদের মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার না করা জন্য একাধিকবার আহ্বান জানিয়েছি।
প্রচুর সম্পদ ও ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে মিয়ানমার সবসময় ভূ-রাজনীতির বড় শক্তিগুলোর কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একদিকে মিয়ানমার থেকে সম্পদ আহরণের জন্য চীন বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে। অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও সমমনা দেশগুলো সেটির বিরোধিতার জন্য মিয়ানমারে বিভিন্ন ধরনের কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। তবে এক্ষেত্রে চীন তাদের নিয়ন্ত্রিত অস্থিরতা (কন্ট্রোল্ড ইন্সটাবিলিট) নীতির মাধ্যমে ভালো অবস্থানে রয়েছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, মিয়ানমার সংলগ্ন বঙ্গোপসাগর থেকে গ্যাস সরবরাহের জন্য চক্তো থেকে কুনমিং পর্যন্ত প্রায় ৮০০ কিলোমিটার পাইপলাইন তৈরি করেছে চীন। ২০১৬ থেকে এখন পর্যন্ত রাখাইনে অনেক ধরনের অস্থিরতার ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু ওই পাইপলাইন দিয়ে গ্যাস সরবরাহ কখনোই বন্ধ হয়নি। মিয়ানমার সরকার, আরাকান আর্মি বা অন্য বিরোধী দলগুলো একটি বিষয় মেনে চলে এবং সেটি হচ্ছে তারা কোনোভাবেই চীনের কোনও স্বার্থে ব্যাঘাত ঘটায় না বলে জানান তিনি।
এই কর্মকর্তা আরও বলেন, এটি থেকে বোঝা যায় মিয়ানমারে যে অস্থিরতা (ইন্সটাবিলিটি) রয়েছে, সেটির ওপর বড় ধরনের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে চীনের। এ জন্য বলা হয়ে থাকে, মিয়ানমারে কন্ট্রোল্ড ইন্সটাবিলিটি নীতি বজায় রাখছে চীন। যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতসহ অন্য সমমনা দেশগুলো চেষ্টা করছে চীনের এই নিয়ন্ত্রণ কমানোর জন্য। বৃহৎ শক্তিগুলোর নিজেদের মধ্যে বিবাদের কারণে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান করা আরও জটিল হয়ে পড়ছে বলে মনে করেন তিনি।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata

‘রোহিঙ্গাদের মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার না করার আহ্বান’
- আপলোড সময় : ৩০-০৫-২০২৪ ১২:১৩:২৪ অপরাহ্ন
- আপডেট সময় : ৩০-০৫-২০২৪ ১২:১৩:২৪ অপরাহ্ন


কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ